কোহলির মাস্টারক্লাস তার সাথে রবীন্দ্র জাদেজার ঘূর্ণির জাদুতে চিপকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিজয় দিয়েই বিশ্বকাপ অভিযান চালু করল টিম ইন্ডিয়া। টার্গেট ছিল মাত্র ২০০। তবে সেই রান চেজ করার জন্য নেমেই ভারতের টপ অর্ডার ধসে পড়েছিল প্ৰথম দু ওভারের মধ্যে। স্টার্ক-হ্যাজেলউডদের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছিলেন ঈশান কিষান, রোহিত শর্মা, শ্রেয়াস আইয়ার।
তারপর? ভিনি, ভিডি, ভিসি। সম্রাট এলেন, দেখলেন এবং বিজয় করলেন। এইরকম একবার।
২/৩ হয়ে গিয়ে ইন্ডিয়া সেই সময় ঠকঠক করে কাঁপছে। তিনিই কার্যত ওপেন করতে নামলেন যেন! স্টার্ক, কামিন্স, হ্যাজেলউডদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সঙ্গী পেলেন অধিক যুদ্ধের তুরঙ্গ কেএল রাহুলকে। প্রথমে থিতু হলেন। পিচের নিসর্গ বুঝলেন। অতঃপর ম্যাচ একপেশে করে দিলেন। ৫২ বল তার সাথে ৬ উইকেট হাতে নিয়ে ইন্ডিয়া অজিদের হারিয়ে বিশ্বকাপে স্বপ্নের সূচনা করল।
চাপের মুখে কোহলি বরাবরের স্পঞ্জ। যাবতীয় চাপ নিঃসঙ্গ শুষে নেন। চিপকের স্লো পিচে নতুন বলেই ইন্ডিয়ার অন্দরে হারের ভীত প্রস্তুত করেছিলেন অজি বোলাররা। নির্ভুল যেন ম্যাকগ্রাথ, ব্রেট লিদের মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন হ্যাজেলউড, স্টার্কদের খাটি লাইন-লেন্থ এবং গতি। কিন্তু কোহলির সেরাটা বেরিয়ে আসে চাপের মুখেই। কেন ফের একবার দেখালেন তিনি!
৮৫ করে হ্যাজেলউডের শর্ট বলে পুল করার জন্য গিয়ে লাবুশানের হাতে শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ তুলে।বিদায় যখন নিলেন, সেই সময় ম্যাচের ভাগ্য কার্যত নির্ভুল হয়ে গিয়েছে। নিজের নিখুঁত ইনিংসে একবার-ই সুযোগ দিয়েছিলেন। মিচেল মার্শ লোপ্পা ক্যাচ মিস করে বসেন। আসলে ম্যাচ টাই মিস করে ফেললেন অজি তারকা। তারপর মাঠ জুড়ে চলল কোহলি-রাজ। কভার ড্রাইভ, পুল তো রয়েইছে, মন্থর পিচে শর্ট আর্ম জ্যাব, দেরি কাটের ভান্ডার নিয়ে জাম্পা-ম্যাক্সওয়েলদের স্পিনকে ভোঁতা করে দিলেন।
অন্যপ্রান্তে কেএল রাহুল যেন স্বপ্নের ছন্দে। এশিয়া কাপ হোক বা অস্ট্রেলিয়া সিরিজে বারবার ব্যাট হাতে রানের দেখা পেয়েছেন। রবিবারের চিপকে তিনি কোহলিকে চাপের মুখে উপযুক্ত সঙ্গত করে গেলেন। ৪র্থ উইকেটে দুজনে ১৬৫ রানের পার্টনারশিপ গড়ে গেলেন। কোহলি আউট হয়ে যাওয়ার পর হার্দিককে সঙ্গে নিয়ে অবশিষ্ট রান তুলতে প্রবলেম হয়নি মিস্টার ডিপেন্ডেবল রাহুলের (৯৭)। মাত্র তিন রানের জন্য শতরান হাতছাড়া হল রাহুলের।
তার প্রথমে বুমরার বলে মিচেল মার্শের ফিরে যাওয়া নিয়ে অজিদের দুর্ভোগ শুরু হয়েছিল। তারপর জাদেজা, কুলদীপের স্পিনে নাকানিচোবানি খেতে হয় অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের।
টসে জিতে প্ৰথমে ব্যাটিং নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অজিরা হয়তো-বা ভাবতেই পারেনি জন্য গোটা ইনিংস জুড়ে এরূপ দুর্ভোগ অপেক্ষা করে রয়েছে। চিপকের পিচে ইন্ডিয়া যে রোটেশন ত্রয়ীকে লেলিয়ে দেবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে অজি শিবিরের গোলা-বারুদ শুরুতেই খতম। আস্ত ইনিংস জুড়েই অজিদের স্পিনের জালে জড়িয়ে রাখলেন অশ্বিন-জাদেজা-কুলদীপরা।
হাত খুলে খেলার সুযোগ পেলেনই না ক্যাঙারুরা। তৃতীয় ওভারেই বুমরার অকস্মাৎ বাউন্স থামিয়ে দিয়েছিল মিচ মার্শকে। বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোহলি যে ক্যাচ নিলেন, তা টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা। বুমরা-সিরাজের চমত্কার ওপেনিং স্পেলের পর অশ্বিন-কুলদীপের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন রোহিত। আর এর পর পুরোটাই আত্মসমর্পণের গল্প।
মার্শ আউট হওয়ার পর অজি শিবিরের হয়ে ওয়ার্নার তার সাথে স্মিথ ৬৯ রানের পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছিলেন। ক্রিজে থাকলেও দুজনের কেউই সাবলীল খেলা খেলতে পারছিলেন। অসহ্য স্পিনের নাগপাশ সহ্য না করতে পেরেই ওয়ার্নার কুলদীপের হাতে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন। অতঃপর টাইম যত গড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়ার রান তোলার গতি ততই থেমে থেমে থমকে গিয়েছে। স্মিথ তার সাথে লাবুশানে দুজনেই ট্রাই করছিলেন যথাসাধ্য। ৩৬ রানের পার্টনারশিপও গড়ে তুলেছিলেন দুজনে।
ম্যাচের সম্ভবত সেরা ডেলিভারিতে জাদেজা ফিরিয়ে দেন স্মিথকে। স্রেফ স্পিনে ঘায়েল করে স্মিথকে প্যাভিলিয়নে ফেরান জাদেজা। স্যার জাদেজা ৩০তম ওভারে লাবুশেন তার সাথে আলেক্স ক্যারিকে ফিরিয়ে অজিদের সম্মানজনক স্কোর করার স্বপ্নেও জল ঢেলে দেন। ক্যামেরন গ্রিনকে আউট করে ম্যাচে নিজের প্ৰথম উইকেট তুলে নেন অশ্বিনও। শেষদিকে মিচেল স্টার্ক না থাকে তাহলে অস্ট্রেলিয়া দুশোর ধারেকাছেও পৌঁছয় না।
এই রানের সম্মুখে ঈশান কিষান প্ৰথম ওভারেই অফ সাইডের বেশি বাইরের বল তাড়া করে স্লিপে দাঁড়ানো ক্যামেরন গ্রিনের হাতে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন। ২য় ওভারে হ্যাজেলউডের ইনসুইং সামনে পেয়ে যায় রোহিতের পা। শ্রেয়স আইয়ার সেই ওভারেই কাট করতে গিয়ে কভারে ক্যাচ তুলে ফিরে। হঠাত্ করেই দমবন্ধ হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেখান থেকে ফের একবার ভারতকে উদ্ধার করল চেজমাস্টারের মাস্টারক্লাস।